স্বাস্থ্য

বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়া জনগণের মৌলিক অধিকার, বলছেন হাইকোর্ট

মোহনা অনলাইন

যুগান্তকারী এক রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। প্রত্যেক নাগরিককে তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রদানের নিমিত্তে আমরা ঘোষণা করছি যে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। তেমনি বিনামূল্যে ভেজালমুক্ত তথা নির্ভেজাল ওষুধ পাওয়াও প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।

ভেজাল প্যারাসিটামল সেবন করে মৃত্যুর ঘটনায় ১০৪ শিশুর পরিবারকে ক্ষতিপূরণের রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ ঘোষণা দিয়েছেন। ৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় আজ প্রকাশিত হয়েছে।

রায়ে আদালত বলেছেন, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। দেশব্যাপী সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও অবকাঠামো প্রশংসনীয় স্তরে উন্নীত হয়েছে। আমাদের ওষুধ শিল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে।

এতে বলা হয়, পৃথিবীর অনেক দেশ বাংলাদেশ থেকে ওষুধ নিয়মিত আমদানি করছে। অনেক প্রতিবেশী দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ বিদেশি ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত পড়ালেখা করে আসছে। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের বর্তমান বাস্তব অবস্থা এই যে, উন্নত ও সু-চিকিৎসা কেবলমাত্র ধনী এবং উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমিত। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তসহ দেশের আপামর সাধারণ জনগণের বলতে গেলে উন্নত চিকিৎসা ও সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত। তারা কেবল নামেমাত্র সামান্য চিকিৎসা পায়।

হাইকোর্ট আরও বলেন, দেশের আপামর জনসাধারণের করের টাকায় সাংবিধানিক পদাধিকারী ব্যক্তিগণসহ সামরিক ও বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিদেশে হরহামেশায় সরকারি অর্থে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করছেন। এমনকি বাংলাদেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের উচ্চপর্যায়ের নেতা ও নেত্রীবৃন্দকেও আমারা দেখি হরহামেশাই বিদেশে চিকিৎসার জন্য গমন করতে। কিন্তু সাধারণ জনগণের বিদেশে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের ন্যূনতম কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ, যে জনগণের টাকায় উপরোল্লিখিত ব্যক্তিগণ বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য গমন করেন, সেই জনগণের কিন্তু বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই।

আদালত বলেন, প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ, যারা সংবিধান মোতাবেক এই দেশটির মালিক, তারা কিন্তু বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য যেতে চান না। তারা চান দেশে বিদেশের মতো উন্নত চিকিৎসা সুবিধা থাকুক সকলের জন্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাথমিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আলমা-আতা ঘোষণা, জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ২৫ (১), আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্মেলনের অনুচ্ছেদ ১২, শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ ২৪, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১২- এসব আন্তর্জাতিক ঘোষণায় স্বাক্ষরদাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে রায়ে হাইকোর্ট আরও বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুযায়ী নাগরিকদের জীবন ধারণের অন্যতম মৌলিক উপকরণ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ঘ) অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিককে তার অন্যতম সামাজিক অধিকার ব্যাধি (illness) তথা রোগ থেকে আরোগ্য লাভের নিমিত্তে সকল প্রকার সরকারি সাহায্য প্রদান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব।

আদালত বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ মোতাবেক রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হলো ‘জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধন’ এবং রাষ্ট্র এটিকে অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে। সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন তথা বেঁচে থাকার অধিকার (right to life) সংরক্ষিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩২ এ বলা হয়েছে যে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তিকে তার বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। অপর কথায়, বেঁচে থাকার অধিকার (right to life) প্রত্যেক ব্যক্তির সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার।

হাইকোর্ট বলেন, বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া না গেলে ব্যক্তি তার জীবন তথা বেঁচে থাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে বাধ্য। সুতরাং, প্রত্যেক ব্যক্তির বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার তথা বেঁচে থাকার অধিকারের (right to life) অন্তর্ভুক্ত।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অর্থাৎ, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক এ দেশের প্রতিটি নাগরিক। এ বিষয়ে আদালত বলেন, বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ায় নাগরিকের জীবন তথা বেঁচে থাকার অধিকার আজ হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশ নামক এ রাষ্ট্রের মালিক জনগণ তথা প্রত্যেক নাগরিককে তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার প্রদানের নিমিত্ত আমরা ঘোষণা করছি যে, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের বিনামূল্যে সকল প্রকার চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া তার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার। তেমনি বিনামূল্যে ভেজাল মুক্ত তথা নির্ভেজাল ওষুধ পাওয়াও প্রতিটি নাগরিকের সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button