বন্যার সময় পানির সরবরাহ প্রায়ই দূষিত হয়ে পড়ে, যা বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ভয়াবহ বন্যাকবলিত এলাকায় বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান, জ্বালানি, ব্যাকটেরিয়ার মত দূষকগুলো বন্যার পানির সঙ্গে খুব বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে খাবার পানি অনেকদিন পর্যন্ত বন্যার দূষিত পানিতে পূর্ণ থাকে। নিরাপদ পানি পান করা বন্যার সময় অত্যন্ত জরুরি।
এক্ষেত্রে খাবার পানির বিশুদ্ধকরণের কয়েকটি উপায় সম্পর্কে চলুন জেনে নেই:
পানি বিশুদ্ধ করা
ফুটিয়ে পানি বিশুদ্ধ করা একটি প্রাচীন এবং সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। এটি যেকোনো জীবাণুমুক্তির প্রাথমিক পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রক্রিয়া—
• প্রথমে পানি একটি পরিষ্কার পাত্রে নিয়ে চুলায় বসান। পানি ফুটতে শুরু করলে একে কমপক্ষে ২০ মিনিট ধরে অবিরত ফুটতে দিন।
• পানি ফুটানোর মাধ্যমে পানি থেকে জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, এবং অন্যান্য জীবাণু উচ্চ তাপে বেঁচে থাকতে পারে না, ফলে পানির মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়।
• ফুটানো শেষে পানি ঠান্ডা হতে দিন। এরপর একটি পরিষ্কার এবং ঢাকনাযুক্ত পাত্রে পানি ঢেলে রাখুন। এই পাত্রটি অবশ্যই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত হতে হবে, যাতে পানি পুনরায় দূষিত না হয়।
ক্লোরিন ট্যাবলেট ব্যবহার
ক্লোরিন ট্যাবলেট পানি জীবাণুমুক্ত করার একটি সাধারণ ও সহজ পদ্ধতি। ক্লোরিন একটি শক্তিশালী জীবাণুনাশক যা পানিতে থাকা জীবাণু ধ্বংস করতে সক্ষম।
প্রক্রিয়া—
• বাজারে বিভিন্ন ধরনের ক্লোরিন ট্যাবলেট পাওয়া যায়, যা সহজেই বহনযোগ্য এবং ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক। প্রতি লিটার পানির জন্য একটি ক্লোরিন ট্যাবলেট পানিতে যোগ করুন।
• ক্লোরিন ট্যাবলেট পানিতে সম্পূর্ণ দ্রবীভূত হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এই সময়ের মধ্যে ক্লোরিন পানির জীবাণু ধ্বংস করবে এবং পানিকে নিরাপদ করে তুলবে।
• ক্লোরিন ট্যাবলেট ব্যবহারের আগে ট্যাবলেটের প্যাকেজিংয়ে দেয়া নির্দেশনা ভালোভাবে পড়ুন এবং সেগুলো মেনে চলুন। সঠিক পরিমাণে ক্লোরিন ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি, কারণ অতিরিক্ত ক্লোরিন পানিতে ক্ষতিকারক হতে পারে।
ব্লিচ ব্যবহার-
ব্লিচের বিভিন্ন ঘনত্বের হয়ে থাকে। ব্লিচ দিয়ে পানি জীবাণুমুক্তকরণ পদ্ধতি শুরুর আগে এর ঘনত্ব জানতে হবে। আর এটি পাওয়া যাবে ব্লিচের লেবেলে। একেক দেশে ঘনত্ব একেক রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্লিচে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইটের ঘনত্ব ৫ থেকে ৬ শতাংশ।
প্রক্রিয়া—
- ব্লিচ দিয়ে জল জীবাণুমুক্ত করার জন্য প্রথমেই পানি ফুটিয়ে পরিষ্কার পানি আলাদা করে নিতে হবে।
- সাধারণত খাবার পানি জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশনা ব্লিচের লেবেলেই দেওয়া থাকে। তবে তা না থাকলে, লেবেলে উল্লেখিত ‘সক্রিয় উপাদান’থেকে সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট শতাংশ নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।
- তারপর একদম অতি সামান্য পরিমাণে ব্লিচ চা-চামচে নিয়ে বিশুদ্ধ পানির প্রতি লিটারে যোগ করতে হবে। মিশ্রণটি ভালো করে নাড়াতে হবে। এরপর কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। জীবাণুমুক্ত পানি পরিষ্কার ও স্যানিটাইজড পাত্রে শক্ত কভারসহ সংরক্ষণ করতে হবে।
ফিটকারি (Fitkari) ব্যবহার
এলুম (Fitkari) বা পটাশিয়াম অ্যালুমিনাম সালফেট একটি প্রাচীন পদ্ধতি, যা পানিতে থাকা কঠিন কণা ও ময়লা অপসারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এটি পানিকে পরিষ্কার এবং পরিশোধিত করতে সাহায্য করে।
প্রক্রিয়া—
• প্রথমে পানিকে একটি পাত্রে নিয়ে অস্বচ্ছ পানি স্পষ্ট করার জন্য ফিটকারি যোগ করুন। প্রতি লিটার পানির জন্য প্রায় ১ গ্রাম এলুম ব্যবহার করুন। ফিটকারি পানিতে দ্রবীভূত হতে সময় নেবে এবং পানিতে থাকা ময়লাগুলো জমা হয়ে নিচে বসে যাবে।
• এলাম যোগ করার পর, পানিকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট রেখে দিন। এই সময়ের মধ্যে পানির নিচে ময়লা জমা হবে এবং উপরের স্তর পরিষ্কার হয়ে উঠবে। পরে এই পরিষ্কার পানিকে অন্য পাত্রে সাবধানে ঢালুন।
• পানি পুনরায় বিশুদ্ধ করা: যদি পানি এখনও সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট না হয়, তাহলে একে পুনরায় ফুটিয়ে বা ক্লোরিন ট্যাবলেট ব্যবহার করে জীবাণুমুক্ত করতে পারেন। এলুম মূলত পানি পরিষ্কার করতে সাহায্য করে, তবে জীবাণুমুক্ত করতে পারে না, তাই এর সাথে অতিরিক্ত পদ্ধতি প্রয়োজন হতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করলে বন্যার সময় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পাওয়া সহজ হবে, যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাতন প্রক্রিয়া-
পানিতে থাকা অন্যান্য দূষিত এবং রোগ সৃষ্টিকারী উপাদানের তুলনায় পানি অল্প তাপেই ফুটতে শুরু করে।
এ পদ্ধতিতে স্ফুটনাঙ্কে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত পানিতে তাপ দিতে হয়। তারপর এটি বাষ্পীভূত না হওয়া পর্যন্ত ফুটন্ত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। এই বাষ্প ঠান্ডা করার জন্য একটি কনডেন্সার ব্যবহার করা হয়। শীতল হওয়ার পরে বাষ্প পরিষ্কার এবং নিরাপদ পানযোগ্য পানিতে পরিণত হয়। উচ্চতর স্ফুটনাঙ্কযুক্ত অন্যান্য পদার্থগুলো পাত্রে পলি হিসেবে রেখে দেওয়া হয়।
এই পদ্ধতি ব্যাকটেরিয়া, জীবাণু, লবণ এবং অন্যান্য ভারী ধাতু যেমন সীসা, পারদ এবং আর্সেনিক দূর করতে কার্যকর। পাতন কাঁচা ও অপরিশোধিত পানির জন্য আদর্শ পদ্ধতি। এই পদ্ধতির সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়ই রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য অসুবিধা হল এটি পানি বিশুদ্ধকরণের সব থেকে ধীর প্রক্রিয়া।
তবে এই পরিশোধন কাজটি করার জন্য একটি তাপীয় উৎস প্রয়োজন। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সস্তা তাপীয় উৎস তৈরি হলেও পাতনের মাধ্যমে পানি বিশুদ্ধ করা এখনো ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াই রয়ে গেছে। এটি অল্প পরিমাণে পানি বিশুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী। বড় আকারের, বাণিজ্যিক বা শিল্প পর্যায়ে পানি পরিশোধনের জন্য এই পদ্ধতি আদর্শ নয়।