‘মব’ নামের নতুন দানব, দেশকে পেছনে টানছে

‘মব’—এক নতুন দানব! এই মব-সংস্কৃতি আগামীর সকল সম্ভাবনা তছনছ করে দেবে। এই দানবকে যারা লালন করছে, একদিন হয়তো তারাই এই দানবের প্রতিপক্ষ হয়ে সামনে দাঁড়াবে। এমনও হতে পারে—কোনো গোষ্ঠী বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। হয়তো তারাই দূর থেকে কলকাঠি নাড়ছে।
মব নামের এই নতুন প্রশ্রয় যদি চলতেই থাকে, তাহলে দেশ ক্রমাগত নৈরাজ্যের পথে হাঁটবে। এর ফলে বিনিয়োগ হবে সবচেয়ে বড় বাধাগ্রস্ত ক্ষেত্র। বিদেশি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বা রাষ্ট্রগুলো এমন অস্থিতিশীল পরিবেশে বিনিয়োগে অনাগ্রহী হবে। উন্নয়ন সহযোগীরা কখনোই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আগ্রহ দেখায় না। দেশে অস্থিরতা থাকলে অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমও ব্যাহত হবে। বিশেষ করে রপ্তানি খাতে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
‘মব’-এর আভিধানিক ব্যাখ্যা হচ্ছে—“বিশাল এবং এলোমেলো মানুষের ভিড়”। ক্যামব্রিজ অভিধানে বলা হয়েছে, “একটি বিশাল, রাগান্বিত জনতা, বিশেষত এমন জনতা যারা সহজেই হিংস্র হয়ে উঠতে পারে”। আরেকটি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “একদল লোক, যারা বন্ধু বা যারা কোনোভাবে একই ধ্যানধারণার অংশ”।
আমার এই লেখা কোনো ব্যক্তি বা পক্ষকে উদ্দেশ করে নয়। লেখার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় বাংলাদেশ। মব নামের এই দানব এখন বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। এটি দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা। সে যে মতাদর্শেরই হোক না কেন, সে দেশ ও রাষ্ট্রের শত্রু। এই শত্রুকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন সম্ভাবনা দেখতে পায়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাকে কেউ বলছে ‘বিপ্লব’, কেউ বলছে ‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান’। আবার কেউ একটু নরম ভাষায় বলছে, ‘সরকার পরিবর্তন’। কিন্তু যাই বলা হোক না কেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক জনগণ মনে করে—এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি অনিয়মের অবসান ঘটেছে, যা দীর্ঘ সময় ধরে দেশের মানুষের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে ছিল। সেই ভূতের বিদায় ঘটেছে। এখন জনগণ আর কোনো অগণতান্ত্রিক শাসন দেখতে চায় না।
এই মব-সংস্কৃতির কারণে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে উঠছে। আজ যা রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে হচ্ছে, আগামীতে তা ব্যক্তিগত বা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হতে পারে। তখন রাষ্ট্রের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর একবার ভেঙে পড়লে তা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত কঠিন হবে। যা কারোরই কাম্য নয়।
এর বাইরেও এক শ্রেণির গোষ্ঠী রয়েছে—দেশের ভেতরে ও বাইরে—যারা চায় বাংলাদেশের উন্নয়ন থেমে যাক। তাদের মনোজগতে একটাই আকাঙ্ক্ষা: বাংলাদেশ যেন একটি ভঙ্গুর ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তখন তাদের পক্ষে রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা সহজ হবে। কিন্তু তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছে—এই উপমহাদেশে একমাত্র বাংলাদেশই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৯০ সালে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতন ঘটিয়েছে। এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট একটি যুগান্তকারী গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফের স্বৈরাচারকে বিতাড়িত করেছে। ভবিষ্যতেও দেশের মানুষ দেশবিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
এই দেশের জনগণ আর কোনো দানব চায় না। স্বৈরাচারকে বিদায় দিয়ে তারা আরেক দানবের আগমন মেনে নেবে না। এই মব-দানবকে কেউ বরদাশত করবে না। তাই এই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর হতে হবে। সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নেবে—এমনটাই প্রত্যাশা করে দেশের সাধারণ মানুষ।
সম্প্রতি সেনাবাহিনী প্রধান বলেছিলেন—আর ‘মব সংস্কৃতি’ বরদাশত করা হবে না। মানুষ এতে আশ্বস্ত হয়েছে। কারণ, এ দেশের মানুষের কাছে সেনাবাহিনী একটি আস্থার প্রতীক। স্বাধীনতার সূচনালগ্ন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে থেকেছে। রাজনৈতিক কিংবা প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগে তারা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানেও তারা ছিল অন্যতম সহায়ক শক্তি।