রাজনীতি

প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা শুরু বিএনপির

মোহনা অনলাইন

জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে ভারতের নিরপেক্ষ ভূমিকার প্রত্যাশায় অনেক দিন ‘নিশ্চুপ’ থেকে অবস্থান বদল করেছে বিএনপি। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে হঠাৎ ভারতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন দলের শীর্ষ নেতৃত্বসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা। নির্বাচনের পর ভারত বিরোধিতায় আরো সরব হয়েছেন দলের নেতাকর্মীরা।

প্রকাশ্যে ভারত বিরোধিতা শুরু বিএনপির

ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে যে প্রচারণা চলছিল, গত বুধবার সেই কার্যক্রমে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিএনপির একজন মুখপাত্র।

এর পরই দলটির ভারত বিরোধিতার বিষয়টি বেশ আলোচনায় আসে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি কি তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতবিরোধী অবস্থান নিল? দলীয়ভাবেই ভারতীয় পণ্য বর্জন প্রচারণায় জড়িয়ে পড়ল?

এ নিয়ে দলের ভেতরেও নানা আলোচনা আছে। ভারতের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান আসলে কী তা নিয়ে দলের নেতাদের মধ্যে বিভ্রান্তিও আছে। ফলে ভারতের বিষয়ে এক সুরে বক্তব্য আসছে না।

বিষয়টি সুরাহার জন্য দলের স্থায়ী কমিটির পরবর্তী বৈঠকে আলোচনা হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

তবে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জনগণের দাবি, মতামত ও বিবেচনাবোধকে অগ্রাহ্য করতে পারে না।

বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের তিনজন নেতার সঙ্গে কথা হলেও তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ভারতের বিষয়ে দলের অবস্থান কী সে বিষয়ে বিভিন্ন সময় দলীয় ফোরামে আলোচনা হলেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বুধবার নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী যে বক্তব্য দিয়েছেন, সে বিষয়ে আগে থেকে জানতেন না দলের নীতিনির্ধারকরা। ফলে রিজভীর বক্তব্য দলের অবস্থান কি না তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দলের কয়েকজন নেতা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ বিষয়টির সমালোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানানোর পরামর্শ দেন তাঁরা।

বিএনপি এখন কী করবে?

দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলীয়ভাবে ভারতের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরোধী অবস্থান ধরে রাখতে চান শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।

তবে সেটি শুধু বিরোধিতার অর্থে নয়। দেশের স্বার্থ ও সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এ বিষয়ে কর্মকৌশল ঠিক করা উচিত বলে মনে করেন তাঁরা।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থানে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। দুই দেশের জনগণের মধ্যকার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠার কথা তার বদলে শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গভীর হয়েছে।

একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর গুলশানের বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন। দলের নেত্রীর সঙ্গে কথার এক পর্যায়ে ভারতের বিষয়টি আলোচনা আনেন ওই নেতা। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করে খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত বিএনপির ভারতবিরোধী কৌশলগত অবস্থানকে সমর্থন করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, সীমান্ত হত্যা, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্যিক বৈষম্য, রাজনীতিতে হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি ভারতবিরোধী অবস্থান গড়ে তোলার পক্ষে নেতাদের প্রায় সবাই একমত। তা ছাড়া ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশের মানুষের ভারতবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিকে বিএনপি সব সময় সমর্থন জানিয়েছিল। সেই রাজনীতির ধারাটা আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।

দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, কিছুদিন আগেও ভারতের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো তাঁদের জন্য ততটা সহজ ছিল না। নির্বাচনের আগে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভারতবিরোধী বক্তব্যের পর সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনের পূর্বাপর কয়েকটি ঘটনা এবং সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় ভারতের উচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে দেশটির পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছিল তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। বিএনপি নেতৃত্ব এবং দেশের অভ্যন্তরীণ কতগুলো বিষয় সামনে আনা হয়েছিল যা কৌশলগত কারণে বিএনপির পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না। দলটির নেতাদের ধারণা, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা এড়াতে ওই সব শর্ত দেওয়া হয়েছিল। ফলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বিএনপির ভারতের বিষয়ে প্রতিক্রিয়াহীন থাকা সম্ভব হয়নি।

বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অনেক কিছু বদলাতে পারলেও প্রতিবেশী পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, এটি বাস্তবতা। আবার ভারত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ, সেটিও অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সবদিক বিবেচনায় আমরা এই গণতান্ত্রিক প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক সব সময় ভালো রাখতে চাই।’

আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করায় দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। এসব কারণে দেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। জনগণের দল হিসেবে বিএনপি জনগণের দাবি, মতামত ও বিবেচনাবোধকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। তাই ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করা।’

দলে ভিন্নমতও আছে

ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিএনপিতে ভিন্নমতও আছে। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই মনে করেন, ভৌগোলিক কারণে ভারতকে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। দেশটির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কৌশলগত প্রতিক্রিয়া বা সমালোচনা করে যেতে পারে। কিন্তু সেটি কোনোভাবেই যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে নয়।

গত বুধবার বিএনপির বক্তব্য ও কাপড় পুড়িয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ শোভনীয় পর্যায়ে ছিল বলে মনে করছেন নেতাদের অনেকে। তাঁদের মতে, ভারত বিরোধিতা মানেই উন্মাদনা নয়। বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই পরোক্ষ সমালোচনার মাধ্যমে ভারত বিরোধিতায় সক্রিয় ছিল। সে অবস্থান থেকে সরে যাওয়া যেমন ভুল ছিল, তেমনি ভারত বিরোধিতা করতে গিয়ে উন্মাদনা তৈরি করাও ঠিক হয়নি।

অবশ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর প্রতিক্রিয়া দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। তিনি একজন নাগরিক ও রাজনীতিক হিসেবে তাঁর নিজস্ব চিন্তা ও বিবেচনাবোধ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের অবস্থান নিয়েছেন।

তবে দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র জানায়, রুহুল কবীর রিজভী যা করেছেন কিংবা বলেছেন, তা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের অজানা নয়। নির্বাচনের আগ থেকে তাঁর মাধ্যমে গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ভারতবিরোধী বক্তব্য আসছিল। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে হলে ধারাবাহিকভাবে ভারতবিরোধী বক্তব্য দিতে পারতেন না তিনি।

খালেদা জিয়ার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন এমন একজন নেতা বলেন, ১৯৯১ সালের সরকার কিংবা ২০০১ সালের জোট সরকারের সময় ভারত বিরোধিতায় ভারসাম্য ছিল। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হয়নি। ইস্যুভিত্তিক সমালোচনায় ভারতকে চাপে রাখা হতো, আবার কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায় সুসম্পর্ক অটুট থাকত। এখন বিএনপি যে মনোভাব নিয়ে এগোচ্ছে তাতে সেই কৌশল নেই।

ভারত-বিএনপি সম্পর্ক

বাংলাদেশে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত সরকারের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। গত প্রায় দেড় দশক ধরে ভারত সরকার নানা ইস্যুতে শেখ হাসিনা সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সফরে আসা তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ বাতিলকে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির জন্য দায়ী করা হয়। তা ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠক বাতিল হওয়ার ঘটনায় দুই পক্ষের মধ্যে চরম অবিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়। এরপর ২০১৪ সালের বিরোধী দলহীন নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভারতের তৎপরতা ছিল দৃশ্যমান। সেবার তখনকার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব নিজেই ঢাকায় এসে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।

এর পরও বিএনপি বিভিন্ন সময় ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা ভারত সফরে গিয়েছিলেন। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আট বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁর সঙ্গেও ভারতের বিভিন্ন পর্যায়ের যোগাযোগ আছে।

বাংলাদেশে একতরফা নির্বাচনের জন্য বিএনপি ভারতকে দায়ী করে দেশটির সরকারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিল। ২০১৮ সালের একাদশ ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে-পরেও বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে একই ধরনের ক্ষোভ ছিল।

বিএনপি নেতারা মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগের ওপর পশ্চিমাদের চাপ থাকলেও ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতায় ‘বিরোধী দলহীন নির্বাচন’ করতে পেরেছে সরকার। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি ভারতের ওপর রুষ্ট হয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button