মতামত

স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং ওয়াজিউল্লাহ

শাহীন রাজা

করোনা সময়কাল যাই যাই করছে। তারপরও সন্ধ্যা নামলেই গোটা শহর নিঃশব্দ নীরবতায় সুনসান হয়ে যায়। এমনই এক রাত। সময়টা ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। একটা রিকশার অপেক্ষায়।

হঠাৎ স্বর্গের রথের মতোই কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে মধ্যবয়সী এক রিকশাচালক। নাম তার ওয়াজীউল্লাহ। এই শহরেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। কথাবার্তায় পুরাই ঢাকার আদিবাসী। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু কানে ইয়ারফোন লাগানো দেখে একটু বিরক্ত হই।

আমাকে রিকশায় তুলেই, ইয়ারফোনটা আবার কানে লাগিয়ে নেয়। বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম, গান শুনবে না রিকশা চালাবে?

“স্থানীয় ভাষায় নরম গলায় বলে, ভাইজান, গানবাজনা না। নাটকও না। বিবিসির খবর শুনবার লাইগা এইটা কানে দিছি।”

বিবিসি! বিবিসি কেন! দেশে এতো রেডিও, টেলিভিশন থাকতে বিবিসির খবর শুনতে হবে?

“ভাই, এইডার মধ্যে একটু দেশের খবর-অবর জানা যায়! রাস্তায় দেখি খবরে কয়, আরেকটা। সব মিথ্যা কথার বাক্স! দেশের যেইগুলা আছে সব-তো শিবের গীত গায়!”

আমাদের সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা এই পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল, বিগত সরকারের আমলে। সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল, তলানি পর্যায়ে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে সার্বক্ষণিক ছিল, সরকারের গুণকীর্তন। পাশাপাশি সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রচার হতো, অপপ্রচার বা বিদ্বেষমূলক প্রচারণা। সংবাদমাধ্যমের কিছু কর্মীদের আচরণ পরিলক্ষিত হতো, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরকারের পক্ষে কথা বলা, বা সরকারকে খুশি করাটাই তাদের কর্ম!

এমন প্রেক্ষিতে ক্রমশই মানুষ সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণামুখী হয়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক খবর নিয়ে জনমনে সংশয় দেখা দেয়। এখানেও সঠিক সংবাদ প্রকাশের থেকে দলীয় কর্মীর ভূমিকা পালন করতে থাকে। সংবাদমাধ্যম সঠিক খবর প্রচার করলে, এই অবস্থা দেখা দিতো না।

এছাড়া নব্বইয়ের শেষভাগে এসে পাঠক সংবাদপত্রে, সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে কার্টুন ছাপা দেখতে পায়। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের শেষ পর্যন্ত তা নিয়মিত ছাপা হতো। সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান এ নিয়ে হয়তো মনে মনে ক্ষুব্ধ হতেন, কিন্তু এ ব্যাপারে কখনও হস্তক্ষেপ করতে দেখা যায়নি।

২০০৯ সালের পর থেকে এ চিত্র পাল্টাতে থাকে। এবং একসময় কোনো সংবাদপত্রই আর সরকার বা সরকারি লোকদের নিয়ে কার্টুন ছাপা থেকে বিরত থাকে। একটা ভয় কাজ করে—এই অপরাধে অনেক বড় দুর্ভোগ নেমে আসতে পারে। এবং হয়েছে-ও তাই!

এক সময় সংবাদপত্রে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ আমেরিকাসহ ইউরোপের সংবাদপত্রে এটা নিয়মিত বিষয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কিংবা ইউরোপের প্রধানমন্ত্রী নিয়ে এমন সব কার্টুন ছাপা হয়, যা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এমনকি পার্শ্ববর্তী অনেক দেশেও বিষয়টি নিয়মিত দেখা যায়।

গত শুক্রবার (২ মে) গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে আগের বছরের (২০২৪) তুলনায় ২০২৫ সালের প্রকাশিত সূচক উপরের দিকে উঠে এসেছে। খুব বেশি না হলেও সংবাদমাধ্যমের জন্য অবশ্যই এটা একটা সুখবর।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম। তাদের ১৫ বছরের শাসনামলে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ৪৪ ধাপ পিছিয়ে ১৬৫তম স্থানে নেমে আসে। এবং এক বছরে তা উন্নতি হয়ে ১৪৯তম স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা অবশ্যই একটা ইতিবাচক পরিবর্তন।

গণমাধ্যম মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন,

“এই বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা দিবসে, আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষার পক্ষে কথা বলি। নীতিগত সততার সাথে তা পালন করি। সাংবাদিকরা গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করেন। তাদের কাজকে অবশ্যই সুরক্ষিত এবং গ্রহণ করতে হবে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য আক্রমণ নয়, এবং সেন্সর করাও উচিত নয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি সাংবাদিকতার একটি নতুন ব্র্যান্ড থেকে অনুপ্রেরণা নেয় যা নীতি ও সততার সর্বোচ্চ মানকে সমুন্নত রাখে। আমরা নির্ভীক এবং বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদনকে সম্মান করি। এমনকি এটি আমাদের দলীয় কর্মকাণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একটি মুক্ত এবং স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্র তৈরি করতে পারে, আবার ভেঙেও দিতে পারে। রাজনীতির ঊর্ধ্বে থেকে জনগণের সেবায় সততা ও বস্তুনিষ্ঠতার সাথে সাংবাদিকতা করা উচিত।
যদি আমরা একটি শক্তিশালী ও টেকসই গণতন্ত্র পেতে চাই, তাহলে সাংবাদিকতার সততা ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। আসুন আমরা সকল মতভেদ ভুলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে নির্বাচিত, জবাবদিহিমূলক সরকার সকলের জন্য মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করবে, যার মধ্যে সংবাদপত্রও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদেরকে সত্য সংবাদের জন্য বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার কাছে নির্ভর হতে হয়েছে। এরশাদের স্বৈরাচার শাসনামলে আবারও বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার দ্বারস্থ হতে হয়। এবং গত পলাতক সরকারের সময় ওয়াজিউল্লাহদের সত্য সংবাদের জন্য বিবিসি শুনতে হয়েছে।

আগামীতে যারাই সরকার পরিচালনা করবেন, তারা ওয়াজিউল্লাহদের কথা মাথায় রাখবেন। কেননা গণতন্ত্র বা নির্বাচনে ওয়াজিউল্লাহরাই সকল ক্ষমতার উৎস!

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button